উপমন্যু রায়
সত্যিই কী অদ্ভুত সময় এলো!
এই পৃথিবী আমার। কারণ, এই পৃথিবীতে আমি জন্মেছি। অন্য কোনও গ্রহে নয়। এখানকার জল–হাওয়ায় আমি বড় হয়ে উঠেছি। বুক ভরে শ্বাস নিয়ে চলেছি। তার মানে, এই পৃথিবীর সব কিছু আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠার পক্ষে ছিল আদর্শ।
কিন্তু আজ? আজ কী এমন হল যে, এখানে বেঁচে থাকার জন্য আমাকে মহাকাশচারীদের মতো বেশ ধরে থাকতে হচ্ছে?
জামা–প্যান্ট না হয় সভ্যতার খাতিরে লজ্জা নিবারণের জন্য প্রয়োজন। কিন্তু, আজ শুধু জামা–প্যান্ট এবং সেই সঙ্গে ধুলো–বালি ও আঘাত থেকে দুই পা রক্ষার জন্য জুতো পরাতেই তো বাইরের ভার বহন করা শেষ হচ্ছে না!
আজ মুখে লাগাতে হচ্ছে মাস্ক, পরতে হচ্ছে ফেসশিল্ড। চুল ঢেকে ফেলতে হচ্ছে বিশেষ ধরনের টুপিতে। হাতে গ্লাভস লাগাতে হচ্ছে।
পাশাপাশি চলে এসেছে পিপিই নামে এক বিশেষ ধরনের পোশাকও। যে পোশাক পরলে আমার আমিটাই হারিয়ে যায় আড়ালে।
আর এতসব পরেই চলাফেরা করতে হচ্ছে আমাদের। অফিস–কাছারি থেকে স্কুল–কলেজ, —কোথায় নয়!
আমি মানে শুধু আমি নই, মানে আমরা। মানে তথাকথিত ‘সভ্য’ দু’পেয়ে এই প্রাণী। যার পোশাকি নাম মানুষ। সবচেয়ে নাকি বুদ্ধিমান প্রাণী!
এখন তো মাস্ক প্রায় বাধ্যতামূলকই হয়ে গিয়েছে। যে বা যাঁরা পরেন না, তাঁদের দিকে আমরা সন্দেহের চোখে তাকাই। পাশাপাশি, ধীরে ধীরে বাকি জিনিসগুলিও অঙ্গে উঠতে শুরু করেছে অনেকের। হয়তো একদিন সেটাও নিয়ম হয়ে যাবে সকলের জন্য। কারণ, আমাদের বেঁচে থাকতে হবে যে এই পৃথিবীতে!
কথা হল, আমি তো এই পৃথিবীতেই জন্মেছি। চলাফেরা করছি। মান–অভিমান করছি। হাসছি, কাঁদছি। অফিস–বাড়ি করছি। মাঠে–ঘাটে যাচ্ছি। তা হলে আমাকে এমন অদ্ভুত আবরণের ভেতরে চলে যেতে হচ্ছে কেন?
মেনে নিতাম, যদি চাঁদ বা মঙ্গলে গিয়ে চলাফেরা করতাম। তা হলে না হয় মহাকাশচারীদের মতো পোশাক পরতাম। না–পরলে তো সেইসব গ্রহ বা উপগ্রহে গিয়ে আমরা বাঁচতে পারতাম না।
কিন্তু পৃথিবীতে কেন আমাদের এমন অদ্ভুত চেহারায় ঘুরে বেড়াতে হবে? যখন পৃথিবীটা আমাদেরই!
যেন নিজ ভূমেই পরবাসী হয়ে যাচ্ছি আমরা!
জানি, উত্তরটা সকলেই জানেন। বলবেনও। কোভিড–১৯ নামে এক ভাইরাসের কথাই উঠে আসবে সকলের মুখে। যে ভাইরাস মৃত্যু পরোয়ানা নিয়ে নাকি অদৃশ্য অবস্থায় বিরাজ করছে আমাদের সাধের পৃথিবীতে। যদিও তার চরিত্র এখনও নিশ্চিত ভাবে বলতে পারছেন না কোনও চিকিৎসা বিজ্ঞানীই।
‘হু’ বা তথাকথিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও বারবার নিজেদের বক্তব্য অদল–বদল করে চলেছে বিভিন্ন সময়ে। প্রথমে জানলাম, এই ভাইরাস নাকি বাতাসে একটানা ভেসে বেড়াতে পারে না। অল্প কিছুটা দূর গিয়ে মাটিতে পড়ে যায়। এখন শুনছি, মোটেও তা নয়। অনেক বিজ্ঞানীই মনে করছেন, এই ভাইরাস নাকি অনেকটা সময় বাতাসে ভেসে থাকারও শক্তি ধরে।
ভাবুন অবস্থাটা! বাতাসে যদি অদৃশ্য আততায়ীর মতো ভাসতে থাকে এই ভাইরাস, মানুষ তা হলে নিজেকে বাঁচাবে কী করে? আর মানুষ না থাকলে এই সভ্যতার কী হবে?
অতএব, বাঁচতে হলে সেই কিম্ভুত–কিমাকার পোশাককেই (পিপিই, মাস্ক, ফেসশিল্ড, টুপি, গ্লাভস ইত্যাদি ইত্যাদি) মেনে নিতে হবে। যদি না এই ভাইরাসকে নির্মূল করা যায়, তা হলে ক্রমে তা স্বাভাবিক হতে থাকবে আমাদের শরীরে, মননে এবং সংস্কৃতিতেও হয়তো।
আর ততই এই পৃথিবীটা, যে পৃথিবীটাকে ভালবেসে কত কবি–সাহিত্যিক, শিল্পীরা অসংখ্য অনবদ্য সব সৃষ্টি করে গিয়েছেন যুগ যুগ ধরে, সেই পৃথিবীটা ক্রমশ আমাদের কাছ থেকে দূরে সরে যেতে থাকবে।
মনে হবে, এই পৃথিবী আমাদের নয়। আমরা ভিনগ্রহ থেকে আসা কোনও প্রাণী যেন। আমরাই অবৈধ ভাবে বসবাস করছি এখানে।
এতদিন সহ্য করে নিলেও এখন আর আমাদের মেনে নিতে চাইছে না সে। তাই আমাদের বেঁচে থাকাটাকেই ক্রমশ কঠিন থেকে কঠিনতর করে দিচ্ছে।
ও–হো, মহাকাশ বিজ্ঞানী এবং গবেষকদের একাংশ তো মনেই করেন, মানুষ পৃথিবীর প্রাণী নয়। সে নাকি এসেছিল অতি দূরের কোনও গ্রহ থেকে।
সেই গ্রহের সম্পদ শেষ হয়ে গেলে বেঁচে থাকার জন্য মানুষ নাকি মহাকাশ জুড়ে খুঁজতে বেরিয়ে পড়েছিল নতুন কোনও গ্রহ, যে গ্রহে সে বেঁচে থাকতে পারে এবং শুরু করতে পারে তার সভ্যতা। খুঁজতে খুঁজতে শেষে সে পেয়েছিল এই পৃথিবীকে। তার পর বহু বছর ধরে তিল তিল করে গড়ে তুলেছে এই সমাজ ও সংসার।
সেই সমাজ ও সংসার কি আজ ফের পৌঁছে গিয়েছে আমাদেরই অপরিণামদর্শিতার পরিণামের দিকে?
জানি না।
এই ভাইরাস প্রাকৃতিক কারণে সৃষ্ট, নাকি মানুষই তৈরি করেছে কোনও স্বার্থসিদ্ধির জন্য, যা আজ গোটা পৃথিবীটাকেই ফেলে দিয়েছে ভয়ঙ্কর এক অবস্থার মধ্যে, তা নিয়ে বিতর্ক চলছেই।
তবে, অনেকেই মনে করছেন, এই ভাইরাস প্রাকৃতিক নয়। প্রাকৃতিক কারণে সৃষ্টি হলে এই ভাইরাসের প্রতিষেধক নাকি এতদিনে তৈরি হয়ে যেত। এই মারণ ভাইরাস মানুষ তৈরি করেছে মানুষের ক্ষতি করতেই। তাই সে হরেক প্রকারের কোভিড তৈরি করে ছড়িয়ে দিয়েছে পরিবেশে। সেই কারণে এই ভাইরাসের এক–একটি ঘনঘন চরিত্র বদল করছে। বোকা বানিয়ে দিচ্ছে হাজার হাজার চিকিৎসা বিজ্ঞানীকে।
আর সেই ভাইরাসকে রুখতে গিয়ে গোটা পৃথিবী স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। সব দেশেরই অর্থনীতি পড়ে গিয়েছে মারাত্মক বিপাকে। যা সর্বনাশ ডেকে আনছে মানুষের জীবন ও জীবিকার। তাই লকডাউন আর আনলক মিলিয়ে চলতে হচ্ছে সকলকে।
ইতিমধ্যে বছরের অর্ধেক সময় চলে গিয়েছে। অথচ খুব একটা পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না পরিস্থিতির। প্রতিদিনই সংক্রমিত ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে।
মনে হচ্ছে, আমাদের জীবন থেকে একটা বছর বোধ হয় চুরিই হয়ে গেল!
যদি না এই ভাইরাসকে রুখে দেওয়ার প্রতিষেধক দ্রুত চলে আসে, এই বছর গড়িয়ে তো যাবেই, হয়তো আগামী বছর, কিংবা তার পরও…!
ইতিমধ্যে এই ভাইরাসের সৌজন্যে আমাদের মানসিক পরিবর্তনের অনেক উদাহরণই দেখা গিয়েছে পৃথিবী জুড়ে।
অনেক জায়গায় অনেক মানুষকে মরে রাস্তায় পড়ে থাকতেও দেখা গিয়েছে। কিন্তু করোনা সংক্রমিত কিনা সন্দেহে কেউ এগিয়ে যায়নি কাছে। কী নিষ্ঠুর হয়ে যাচ্ছি আমরা!
অনেক জায়গায় আবার করোনা সংক্রমণে প্রিয়জন মারা গেলেও প্লাস্টিকের ব্যাগে ভরে বাড়ির বাইরে বুকের ভেতর যন্ত্রণা চেপে রাস্তায় রেখে গিয়েছেন অনেকে। সৎকার করতে এগিয়ে যাননি তাঁরা।
এটা হয়তো স্বার্থপরতা। আবার সেইজন্য তাঁদের দোষও দেওয়া যায় না। অদৃশ্য আততায়ীর হাত থেকে বাঁচার পথ তো এখনও খুঁজে পায়নি আমাদের সভ্যতা!
তার মানে, এখন পৃথিবীর চেহারাটা যে পর্যায়ে পৌঁছেছে, তাতে মনে হচ্ছে, আমাদের সামনে রয়েছে দুটো পথ।
এক, এই ভাইরাস থেকে নিজেদের মুক্ত রাখতে পারস্পরিক দূরত্ব বজায় রেখেই চলতে হবে সকলকে। আর সেটাই হয়ে উঠবে আমাদের জীবনাচরণের একটি স্বাভাবিক রীতি।
কিন্তু তা করতে গিয়ে কোভিডের পাশাপাশি আমরাও যেন ক্রমশ ‘সন্দেহ’ নামক এক ভয়ঙ্কর রোগেরও নজরবন্দি হয়ে যাচ্ছি।
সত্যিই তাই, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে গিয়ে এই সময়ে আমরা যেন একে অপরকে অবিশ্বাস করতে শুরু করেছি। চেনা–অচেনা, যে–ই হোন, মনে হচ্ছে, তিনি করোনা–মুক্ত কি? নাকি—!
আর এ ভাবেই যেন ধীরে ধীরে আমরা একে অপরকে সন্দেহের চোখেও দেখতে শুরু করে দিয়েছি। তাই অপরের কাছ থেকে আস্তে আস্তে দূরেও সরে যাচ্ছি।
এমন অবস্থা যদি চলতে থাকে, সেইদিন আর বেশি দূরে নেই, যে–দিন আমরা এক–একজন যেন বিচ্ছিন্ন এক জম্বুদ্বীপে পরিণত হব! কী ভাবে চলব আমরা তার পর?
আর, দ্বিতীয় পথটা হল, এই ভাইরাস–আক্রান্ত সময় আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে আমরা কতটা অসহায়! কতটা একা!
তা ছাড়া, এ কথা তো কারও অজানা নেই যে, পৃথিবীতে কোনও জীবের পক্ষেই একা বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। মানুষের পক্ষে তো নয়ই।
আচমকা থেমে যাওয়া পৃথিবী আমাদের আরও বেশি করে বুঝিয়ে দিচ্ছে, আমাদের একজনের অন্যকে কত প্রয়োজন। হাসি–কান্না, সুখ–দুঃখ, মান–অভিমান সমস্ত ক্ষেত্রেই তো আমাদের পাশাপাশি চলতে হয়।
থেমে যাওয়া এই সময় যেন আরও বেশি করে মনে করিয়ে দিতে চাইছে সে কথা। (এ কথা তো আগের নিবন্ধগুলোতেই অনেকবার বলেছি।)
এখন কথা হল, আমরা কোন পথটা বেছে নেব? আমাদের তনু–মন–প্রাণ কি গ্রাস করে নেবে সন্দেহের ধুম্রজাল? নাকি, আমরা আবার পরস্পরের দিকে বাড়িয়ে দেব বন্ধুত্বের হাত? পরম নির্ভরতার আশ্বাস?
বলব, বন্ধু, তুমি একা নও। আমি আছি তোমার পাশে। বলব, আমিও একা নই। কারণ, তুমি আছ আমার পাশে।
এই তো সময় আত্মোপলব্ধির। আমাদের দর্শন কি পারবে সঠিক পথটা খুঁজে দিতে?